আর্থ্রাইটিস বলতে সাধারনত জয়েন্টের প্রদাহ কে বোঝানো হয়। বাংলায় এটিকে বলা হয় বাত। তথ্য অনুযায়ী মানুষের অক্ষমতার প্রথম এবং প্রধান কারন হচ্ছে এই আর্থ্রাইটিস। এটি কোনো নির্দিষ্ট একটি রোগ নয়। এটি এক বা একাধিক জয়েন্টকে আক্রান্ত করতে পারে। বিভিন্ন গবেষনায় দেখা গেছে বিশ্বে প্রতি ৫ জনের ১ জনি আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত। শুধু আমেরিকাতেই এখনো সাত মিলিয়নেরও বেশি লোক এই রোগে আক্রান্ত। আর আমাদের দেশে প্রায় ২৫ শতাংশ লোক কোনো না কোনো ভাবে আর্থ্রাইটসে আক্রান্ত। মানুষের শরীরের কোনো রোগ ছারাই বিভিন্ন জয়েন্টে যে ব্যাথা অনুভূত হয় তাই আর্থ্রাইটিস বা বাত বলে প্রমানিত। আর্থ্রাইটিসের লক্ষন কি? কি কি ধরনের আর্থ্রাইটিস আছে? কিভাবে এর থেকে প্রতিকার পাওয়া সম্ভব? এমন কিছু তথ্য আজ আমি আপনাদের জানানোর চেষ্টা করব।
আর্থ্রাইটিসের লক্ষন কী?
চিকিৎসকেরা বলছেন আর্থ্রাইটিসের সাধারন লক্ষন বা উপসর্গ হলো হাড়ের জয়েন্ট এর সাথে সম্পর্কিত। সাধারনত জয়েন্টে অতি মাত্রায় ব্যাথা অনুভূত হয়। জয়েন্ট ফুলে যায়। এছারা হাতের আঙ্গুল, কনুই,কাঁধ,হাঁটু,গোড়ালি ও পায়ের পাতায় ব্যাথা অনুভূত হয় একজন রোগীর। শরীরের পাশে এক সঙ্গে ব্যথা অনুভূত হয়। যেমন: হাতে হলে দুই হাতের জয়েন্টে এক সাথে ব্যাথা অনুভূত হয়। অনেক সময় শরীর দূর্বল লাগে। জ্বর জ্বর অনুভূত হয়। সাধারনত বয়স্করা সবচেয়ে বেশি আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুকিতে থাকে। তাছারা পরিবারের মা, বাবা,ভাই,বোন এই রোগে আক্রান্ত থাকলেে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুকির মাত্রা আরো বেরে যায়।
আর্থ্রাইটিসের ধরন:
চিকিৎসকেরা বলছেন আর্থ্রিইটিসের সবচেয়ে সাধারন ধরন হলো অস্টিওআর্থ্রাইটিস ও রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস। তাদের ভাষায় আর্থ্রাইটিস মূলত অনেক গুলো ধরনের সমন্বিত রোগ। প্রায় ২০০ ধরনের আর্থ্রাইটিস সমস্যার কথা জানতে পেরেছে বিজ্ঞানীরা। তবে কিছু সাধারন ধরন খুব বেশি পরিচিত। এর মধ্যে রয়েছে অস্টিওআর্থ্রাইটিস ও রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস। এছারা রক্তের মাধ্যমে জীবানু যখন হাড়ের জয়েন্টে গিয়ে ইনফেকশন তৈরি করে তখন তীব্র ব্যথা হয়। এটাকে সেপটিক আর্থ্রাইটিস বলে। এছারা রয়েছে বেশ কিছু প্রদাহজনক আর্থ্রাইটিস। আমাদের শরীরের ভিতরে রক্তের মধ্যে কিছু উপাদান তৈরি হয়। যেই উপাদান গুলো আসক্তি থাকে আমাদের জয়েন্টে। এই আথ্রাইটিসগুলো গিয়ে সরাসারি জয়েন্টে অক্রমন করে। আর এই আথ্রাইটিস গুলো রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে চিকিৎসকেরা সনাক্ত করে থাকে। কিছু কিছু আর্থ্রাইটিস আছে যেগুলো শুধু অল্প বয়সের বাচ্চাদের হয়। আবার কিছু কিছু আর্থ্রাইটিস আছে বয়স্কদের হয়।
অস্টিওআর্থ্রাইটিস কী?
চিকিৎসকেরা বলছেন সাধারনত অস্টিও আর্থ্রাইটিস ধীরে ধীরে হয়। এর প্রাথমিক লক্ষন হলো শারীরিক পরিশ্রম ও ব্যয়াম করলে জয়েন্টে ব্যথা হয়। সময়ের সাথে সাথে সেই বেথা বাড়তে থাকে। অস্তিসন্ধি ফুলে যায় ও ব্যথা করে। শরীরে জড়তা দেখা দেয়। সাধারনত ঘুম থেকে উঠার পর বা দীর্ঘ সময় বসে থেকে উঠার পর এই জড়তা দেখা দিতে পরে। সাধারনত ব্যায়াম ও শারীরিক পরিশ্রমের পর জয়েন্টে তীব্র ব্যথা হয়। কড়মড় শব্দ হয় অনেক সময়। অস্টিওআর্থ্রাইটিস বেশি হয় হাঁটুর জয়েন্টে। উঁচু কোথাও ঘুরতে গেলে হাঁটুতে বেশি চাপ লাগে। হাতে যদি ভারি কোনো বাহন থাকে তাহলে সেটা বহন করা অসম্ভব হয়। হাঁটু ফুলে যায়। কমরে হলে নাড়াচরা কারা কঠিন হয়। বিশেষ করে শরীরের নিচের অংশ। হাতের মধ্যে হলে বৃদ্ধা আঙুলে বেশি হয়। আঙুলে ব্যথা হয়, ঝিম ঝিম করে ও ফুলে যায়। জয়েন্টের আশে পাশে গোটার মত গুটিও দেখা দিতে পারে। মেরুদন্ডে হলে ঘার ও কোমরে উভয় স্থানে ব্যথা হতে পারে। কখনো কখনো হাত পা ঝিম ঝিম করে।
কারা অস্টিওআর্থ্রাইটিসির ঝুকিতে আছেন?
যাদের বয়স বেশি তাদের অস্টিও আর্থ্রাইটিসের ঝুকিও বেশি। বয়স ৬৫ এর বেশি হলে অস্টিওআথ্রাইটিস হওয়ার ঝুকি বাড়ে। ৪৫ বয়সী পুরুষের এবং ৪৫ বয়সী পরবর্তী নারীদের এটি বেশি হয়। অস্তির সন্ধিত যে কোনো আঘাত পেলে অস্টিও আর্থ্রাইটিসের ঝুকিটা বেড়ে যায়। এ কারনে যারা পেশাগত কারনে শারীরিক পরিশ্রম বেশি করেন বা আঘাতর ঝুকিত থাকেন তাদের আর্থ্রােইটিসের ঝুকি বেশি। যাদের ওজন বেশি তাদের অস্টিও আর্থ্রােইটিস বেশি হয়। সাধারনত স্থুল শরীরের মানুষের হাঁটুতে রোগটি বেশি দেখা দেয়। কিছু ক্ষেত্রে বংশগত কারনেও অস্টিও আর্থ্রােইটিস হতে দেখা যায়।
রিউমাটয়েড আর্থ্রােইটিস কী?
এটাক অটোইমিউন ও প্রদাহ জনিত রোগ হিসেবে উল্লেখ করেন চিকিৎসকরা। এতে শরীরের নিজশ্ব কিছু রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার কারনেেই কিছু টিস্যু ক্ষতি গ্রস্ত হয়। অস্তির সন্ধির বাইরের আবরনে প্রদাহ হয়। এ কারনে জয়েন্ট ও এর আশেপাশে ব্যথা হয়, জড়তা তৈরি হয়, ফুলে যায়, লাল হয়ে যায় এবং অনেক সময় শরীরে জ্বর জ্বর অনুভতি হয়। টিস্যু ক্ষতিগ্রস্ত হবার কারনে ব্যথা অনক বেড়ে গিয়ে শরীরের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। ক্রনিক ব্যথা, ব্যলেন্সে সমস্যা অর্থাৎ শরীর জড়তা তৈরি হতে পারে।
রিউমাটয়েড আর্থ্রােইটিসের লক্ষন:
রোগটি দীর্ঘ মেয়াদি বা ক্রনিক। তাই কখোনো কখোনো লক্ষন প্রকাশ পায় আবার কিছু দিন কোনো লক্ষনই থাকে না। ঘুম থেকে উঠার পর শরীরের জয়েন্ট সহ কিছু অংশে ব্যাথা ও জড়তা থাকে। হাতর আঙুল, কোনুই, কাধ ,পায়ের পাতা, হাটু ও গোরালিত বেশি সমস্যা হয়। সাধারনত শরীরের উভয় পাশ এক সঙ্গে আক্রান্ত হয়। যেমন হাতে হলে দুই হাতেই হয় এক সঙ্গে ব্যাথা করে ফুলে যায়। দূর্বল লাগে, জ্বর জ্বর অনুভতি হয় ও শরীর ম্যাচ ম্যাচ করে।
প্রতিরোধর উপায়:
১) শারীরিক ভাবে সক্রিয় থাকতে হবে। যেমন নিয়মিত হাঁটতে হবে।
২) মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের ব্যয়াম করা।
৩) ওজন নিয়ন্ত্রনে রাখতে হবে।
৪) প্রতিদিন প্রচুর পরিমানে পানি পান করতে হবে।
৫) ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন যুক্ত খাবার বেশি করে খেতে হবে।
৬) যে কোন ছোট খাটো ব্যথার চিকিৎসা করাতে হবে।
৭) ধুম পান ও মদ্য পান ছারতে হবে। কারন অ্যালকোহল হাড়ের স্বাস্থ ও কাঠামো দূর্বল করে দেয়।
৮) নিয়মিত দুধ বা দুধ জাতীয় খাবার গ্রহন করতে হবে।
৯) কারো যদি ল্যকটিস জাতীয় খাবারে সমস্যা থাকে তাহলে ক্যালসিয়াম ও প্রটিন জাতীয় খাবার বেশি খেতে হবে।
১০) মেনোপোজের পর ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি জাতীয় খাবার খাওয়া খুবই গুরুত্ব পূর্ন।
চিকিৎসা:
কারো যদি আর্থ্রাইটিসের সমস্যা দেখা দেয় তাহলে অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। রোগির ইতিহাস ও উপসর্গ দেখে চিকিৎসক কিছু পরীক্ষা নীরিক্ষা করার পরামর্শ দিতে পারেন। যেমন রক্তর মাধ্যমে যেই আর্থ্রাইটিস শরীরে ছরায় তা রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে চিকিৎসকরা চিহ্নিত করে থাকে। আবার হাড়ে বা জয়েন্টে যে ব্যথা হয় সেগুলো এক্সরের মাধ্যমে চিকিৎসকরা চিনে থাকেন। এই গুলো মূলত অস্টিও আর্থ্রাইটিস। খাদ্য অভ্যাস পরিবর্তন,ওজন নিয়ন্ত্রনে রাখা,নিয়মিত ব্যায়াম,ক্যালসিয়াম জাতীয় খাবার খাওয়ার ইত্যাদির মত চিকিৎসার পরামর্শ দিয়ে থাকে চিকিৎসকরা। এই গুলো নিয়মিত চর্চার ফলে রোগীরা অনেকাংশেই তাদের রোগ নিয়ন্ত্রনে বা কমিয়ে রাখতে পারে। আবার কিছু আর্থ্রাইটিস আছে যেগুলো চিহ্নিত করার পর নির্দিষ্ট ওষুধ এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রনে রাখতে পারে। আর্থ্রাইটিসের ধরন অনুযায়ী ওষুধ সহ ফিজিওথ্যারাপির পরামর্শও দিয়ে থাকে চিকিৎসকরা। কখনো কখনো এমন হয় যে রোগীর রোগর যায়গা পরিবর্তন হয়। আবার দেখা যায় যে রোগী ব্যথায় ঠিক মত হাটঁতে পারছেন না আবার কিছুক্ষন বিশ্রাম নিলেই সেই ব্যাথা কমে যাচ্ছে। এই ধরনের রোগীর ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা ফিজিও থ্যারাপিস্ট এর পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এই ধরনের আর্থ্রাইটিস রোগীকে বিভিন্ন ধরনের থ্যারাপির মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়।
সুতরাং,আর্থ্রাইটিস রোগ এর কোনো রকমের কোন লক্ষন আপনার মধ্যে প্রকাশ পেলে দ্রুত একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রোগ নিরাময়ের ব্যবস্থা করুন। নিয়মিত খাদ্য গ্রহন করুন নিয়মিত শরীর চর্চা করুন আর সুস্থ সাভাবিক জীবন যাপন করুন।