কেউ কেউ রাতে পাশ ফিরে ঘুমাতে পছন্দ করে। আবার কেউ কেউ চিৎ হয়ে ঘুমিয়ে থাকেন। কিন্তু রাতে পরিপূর্ণ বিশ্রামের জন্য কোন অবস্থায় ঘুমালে স্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে ভালো? আপনার দেহের জন্য আরামদায়ক ও স্বাস্থ্যকর ঘুম কোনটি এই নিয়ে বৈজ্ঞানিক প্রমাণ কি বলছে। চলুন জেনে নেওয়া যাক-
ঘুম আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্বেও বেশ অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার হলো যে এ নিয়ে এখন পর্যন্ত বড় মাপের কোনো গবেষনাই হয় নি। আমাদের প্রথমে জানা প্রয়োজন মানুষ ঘুমের মধ্যে কোন ভঙ্গিতে ঘুমিয়ে থাকে। এর সব থেকে সহজ উপায় হলো তাদের সেটা জিঙ্গেস করা। কিন্তু সমস্যা হলো আমরা মনে করতে পারি কেবল শুধু মাত্র আমরা ঘুম আসার আগে কোন ভঙ্গিতে শুয়ে ছিলাম আর ঘুম থেকে জেগে ওঠার সময় আমাদের দেহের ভঙ্গি কেমন ছিলো। এই বিষয়টি সম্পর্কে আরও জানতে গবেষকরা নানান ধরনের কৌশল ব্যবহার করছেন। যার মধ্যে রয়েছে গুমন্ত মানুষের ভিডিও রেকর্ডিং কিংবা তাদের শরীরে নানান ধরনের ঘুমের ডিভাইস ব্যবহার করে ঘুমের গতিবিধি পর্যবেক্ষন করা। হংকং এর গবেষকরা একটি পদ্ধতি তৈরি করছেন যার মাধ্যমে ইন্টোরেট ক্যামেরা ব্যবহার করে কম্বলের নিচে শুয়ে থাকা মানুষের দেহের ভঙ্গি সম্পর্কে জানা যায়। আবার ডেনমার্কের একদল গবেষক ভলেনটিয়ার দের ঘুমাতে যাওয়ার আগে তাদের শরীরের বিভিন্ন স্থানে মোশন সেন্সর ব্যবহার করে তাদের পছন্দের ঘুমের ভঙ্গি সম্পর্কে জানার চেষ্টা করছেন। তারা দেখতে পেয়েছেন যে, বিছানায় ঘুমিয়ে থাকার সময় মানুষ অর্ধেকেরও বেশি সময় পাশ ফিরে ঘুমায়। প্রায় ৩৮ শতাংশ মানুষ চিৎ হয়ে ঘুমায় এবং ৭ শতাংশ মানুষ ঘুমায় উপর হয়ে। পরিসংখ্যান বলছে যাদের বয়স যত বেশি হয় তারা তত বেশি সময় ধরে কাত হয়ে ঘুমায়। অন্য দিকে ৩ বছরের বেশি বয়সের শিশুরা চিৎ হয়ে, উপর হয়ে, পাশ ফিরে গড়ে পারতায় সমান সময় ব্যয় করে থাকে। আর ৩ বছরের নিচের শিশুরা প্রধানত চিৎ হয়েই ঘুমায়। কারণ নিরাপত্তার জন্য তাদের এভাবেই ঘুমিয়ে রাখা হয়। সুতরাং বেশির ভাগ মানুষ পাশ ফিরে ঘুমায়।
কিন্তু কোন পাশ ফিরে ঘুমানো টা সবচেয়ে বেশি উপকারী?
খুবই ছোট্ট একটা পর্যবেক্ষন মূলক গবেষনা থেকে জানা যাচ্ছে যে, যারা ডান দিকে পাশ ফিরে ঘুমায় তাদের ঘুমের মান যারা বাম পাশ ফিরে ঘুমায় তাদের থেকে তুলনা মূলক ভাবে ভালো। এরপর রয়েছে যারা চিৎ হয়ে ঘুমায় তারা। তবে চিৎ হয়ে ঘুমানোর অসুবিধাও আছে।
কন্টেইনারবাহী জাহাজের নাবিকদের উপর চালানো আর একটি ছোট্ট গবেষনার মাধ্যমে জানা গেছে নাক ডাকার মতো বেশি সমস্যা দেখা যায় যখন নাবিকরা তাদের পিঠের উপর ভর করে চিৎ হয়ে ঘুমিয়ে থাকেন। নাক ডাকার কিছু গুরুত্বর সমস্যার সৃষ্টি হয় অপসট্রাকটিভ স্লিপ এপনিয়ার কারনে। যেখানে ঘুমের মধ্যে একবার শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ একবার চালু হয়। যারা নিয়মিত চিৎ হয়ে ঘুমান তাদের মধ্যে এটি বেশি দেখা যায়।
অন্যদিকে পাশ ফিরে ঘুমালে আপনার শ্বাস নালির উপরের দিকে কোনো বাধা থাকে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা গেছে চিৎ হয়ে ঘুমানোর পরিবর্তে পাশ ফিরে ঘুমালে স্লিপ এপনিয়ার সমস্যা পুরোপুরি দুর হয়ে যায় বলে দেখা গেছে। পাশ ফিরে বা কাত হয়ে ঘুমানোর অন্যান্য সুবিধাও আছে। যেমন- নাইজেরিয়ার একদল গবেষকরা বলছে যে যারা চিৎ হয়ে ঘুমায় তাদের পিঠে ব্যাথা হওয়ার সম্ভাবনা, যারা পাশ ফিরে ঘুমায় তাদের তুলনায় বেশি। তার মানে এই নয় যে পাশ ফিরে ঘুমানোর ব্যাপারটি সবার জন্য সমান ভাবে কাজ করে না কিংবা শরীরের সকল ব্যাথা দুর হয়ে যাবে। এটা নির্ভর করবে আপনার অসুস্থ্যতা কতটা গুরুত্বর বা আপনি কোন ভঙ্গিতে ঘুমাতে সাচ্ছন্দ বোধ করেন তার উপর।
ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার গবেষকরা ভলেন্টিয়ারদের বেড রুমে রাতে ১২ ঘন্টা করে সয়ংক্রিয় ক্যামেরা ব্যবহার করে দেখেছেন যে যারা ঘুম থেকে উঠে জানিয়েছেন তাদের ঘারে ব্যাথা হচ্ছে, তারা বেশির ভাগ সময় কাত হয়ে ঘুমিয়েছেন। কিন্তু যারা কাত কিন্তু সমান ভাবে ঘুমায় তাদের ঘারে ব্যাথা কম হয় বলে জানা যাচ্ছে।
পর্টুগালের ফিটনেস প্রোগ্রামে অংশ নেওয়া বয়স্ক ব্যক্তিদের উপর এক গবেষনায় পিঠের ব্যাথায় আক্রান্তদের পাশ ফিরে আর যাদের গাড়ে ব্যাথা রয়েছে তাদের চিৎ হয়ে ঘুমানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছিলো। চার সপ্তাহ পর নব্বই শতাংশ অংশগ্রহনকারী জানিয়ে ছিলেন যে, তাদের ব্যাথা কমে গেছে। এই ফলাফলকে বেশ আকর্ষনীয় মনে হলেও এর একটি সমস্যা রয়েছে। মাত্র বিশ জন সদস্য এই গবেষনায় অংশ নিয়েছিলেন। গবেষনার নমুনা হিসেবে এটি খুবই ছোটো তাই এর উপর ভিত্তি করে এই উপসংহার টানা সম্ভব নয় যে ঘুমের অবস্থানের সামান্য পরিবর্তনে পিঠ কিংবা ঘাটের ব্যাথা দূর করা সম্ভব। এই নিয়ে আরও বৈজ্ঞানিক গবেষনার প্রয়োজন রয়েছে।
আবার আপনি যদি বুক জ্বালাপোড়ায় ভুগেন তাহলে বাম পাশ ফিরে ঘুমানোর চেষ্টা করতে পারেন। কারন এতে পাকস্থলি ও খাদ্যনালির মধ্যে সংযোগস্থলটি গ্যাসটিক এসিডিস স্তরের উপরে থেকে যায়। কিন্তু সেই সব লোকদের কি হবে যারা সংখ্যায় ছোট হলেও যারা উপর হয়ে ঘুমায়। এক্ষেত্রে শুরুতেই একটি গবেষনার কথা বলা যেতে পারে যেখানে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে যে আপনি যদি চোয়ালের ব্যাথায় ভুগেন তাহলে উপর হয়ে না ঘুমানোই ভালো।
এছাড়া মুখের বলিরেখা সম্পর্কে এসথেটিক সার্জারি জার্নালের লেখা এক নিবন্ধে একদল প্লাষ্টিক সার্জন পরামর্শ দিয়েছেন যে, “আপনার মুখের ত্বকের সবচেয়ে ভালো যত্ন হবে যদি এর সাথে সমুদ্রের শৈবালের মতো আচরণ করা হয়, যেখানে শৈবালটি একটি ডাটার সাথে সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে সাথে দুলতে থাকবে।” তাই ঘুমানোর সময় আপনার মুখের উপর চাপ একদম কম রাখবেন এবং উপর হয়ে ঘুমানোর চিন্তা বাদ দিতে হবে। এবং মুখের ত্বকের যত্নই যদি আপনার ভালো ঘুম, ব্যাথা আর এ্যাসিক রিফ্যাক্স এর থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয় তাহলে পাশ ফিরে ঘুমানোও আদর্শ সমাধান নয়।
তাহলে এসব গবেষনা থেকে আমরা কি উপসংহারে আসতে পারি? অন্য সব কিছু বিবেচনা করে বলা যায় পাশ ফিরে ঘুমানো টাই বেশি উত্তম বলে মনে হয়। তবে সুনির্দিষ্ট যে ভঙ্গিতে আপনি ঘুমাবেন তাতে ঘাড় ও মাথার উপর প্রভাব পড়তে পারে এবং আপনি যে ভঙ্গিতে ঘুমাবেন তার ফলে আপনার এসিড রিফ্যাক্স বাড়তে বা কমতে পারে। আপনি যদি চিৎ হয়ে ঘুমান তাহলে নাক ডাকা বাড়তে পারে। কিন্তু মানুষ হিসেবে আমরা সবাই আলাদা। তাই আপনার ঘুমের সবচেয়ে আরামদায়ক ভঙ্গিকে খুজে পাওয়া সহজ নাও হতে পারে। নতুন ভঙ্গিতে ঘুমিয়ে চেষ্টা করে দেখতে পারেন কারন রাতে ঘুম ভালো না হলে সে কথা ডায়েরিতে লিখে রাখা দরকার। সবশেষ মনে রাখবেন ভিন্ন ভিন্ন ভঙ্গিতে ঘুমানো নিয়ে বেশি দুশচিন্তা করবেন না। কারণ এই দুঃচিন্তার ফলে হয়তো আপনাকে আরও অনেক নিরঘুম রাত কাটাতে হতে পারে।
ধন্যবাদ।