স্লিপ অ্যাপনিয়া (sleep apnea): ঘুমের মধ্যে দম আটকে গেলে কী করবেন?

Health

আপনি কি রাতে অস্বাভাবিক নাক ডাকেন? ঘুমের মধ্যে হাঁস ফাঁস লাগে? অনেক ক্ষন ঘুমানোর পরও ক্লান্তিবোধ যায় না? মেজাজ খীটখীটে লাগে? যদি আপনার মধ্যে এই লক্ষন গুলো দেখা দেয় তাহলে বিষয়টিকে হালকা ভাবে না নিয়ে দ্রুত একজন বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ এর পরামর্শ নিন। কারন এর সবই অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া এর লক্ষন। যার চিকিৎসা সময় মত না করলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এছারা স্লিপ অ্যাপনিয়ায় আক্রন্ত ব্যক্তিরা গাড়ি চালাতে গিয়ে র্দূঘটনা, চাকরি থেকে বরখাস্ত হওয়া এমনকি সঙ্গির সাথে সম্পর্কের অবন্নতি হওয়ার মত সমস্যার সম্মুখিন হয়ে থাকে। তবে কেও যদি রোগ সনাক্তের সাথে সাথে ব্যবস্থা নেন তাহলে এই রোগ অনেকটাই নিয়ন্ত্রনে রাখা সম্ভব। 

স্লিপ অ্যাপনিয়া কি? 

স্লিপ হলো ঘুম আর অ্যাপনিয়া বলতে মেডিকেলের ভাষায় শ্বাসরুদ্ধ হওয়া বুঝায়। সে হিসেবে স্লিপ অ্যাপনিয়া হলো ঘুমের সময় শ্বাসনালী কিছু সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে যাওয়া। শ্বাসনালী যতক্ষন বন্ধ থাকে ততক্ষন রোগী নিশ্বাস নিতে পারে না। এতে বাইরে থেকে অক্সিজেন বাতাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করতে পরে না। এতে মস্তিষ্ক র্হাট এবং শরীরের যেকোনো অঙ্গপ্রতঙ্গ কিছুক্ষনের জন্য হলেও অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয় ফলে এসব অঙ্গগুলো ধীরে ধীরে ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। যার প্রভাবে র্হাট অ্যাটাক, স্ট্রোক, উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিস এর মত ঝুকি বেড়ে যায়। ব্রিটেনের জাতীয় সাস্থ সেবা বিভাগের তথ্য মতে ঘুমের সময় আমাদের ঘার ও গলার চার পাশের মাংস পেশির সিথীল ফলে ভিতরের দিকে এড়িয়ে পর। এ কারনে ঘুমানোর সময় সবারি শ্বাসনালীর কিছুটা সংকচন ঘটে। যাদের পেশির সিথীলতা অন্যদের তুলনায় বেশি বিশেষ করে যারা স্থুলতায় ভুগছেন তাদের শ্বাসনালীর সংকচন অনেক বেশি হয়। যা শ্বাসনালীরি পথ বন্ধ করে দিতে পারে। শরীরের অঙ্গ প্রতঙ্গ সচল রাখতে অক্সিজেন খাদ্যের মত কাজ করে। যখন অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় তখন মস্তিষ্ক সিগনাল দিয়ে রোগীকে জাগিয়ে রাখে। যেন তনি নিশ্বাস নেন এবং সংকচিত শ্বাস নালী খুলে যায়। এভাবে স্লিপ অ্যাপনিয়ায় আক্রান্ত রোগীরা বার বার জেগে উঠে এবং বার বার ঘুম ভাঙার কারনে তারা ক্লান্ত থাকে। দিনের বেলায়ও তারা ঝিমাতে থাকে। সুইডেনের এক গবেষনায় দেখা গিয়েছে যাদের স্লিপ অ্যাপনিয়া আছে তাদের গাড়ি চালানোর সময় র্দূঘটনায় পরার আশঙ্কা আরাই গুন বেশি। এছারা চাকরি থেকে বরখাস্ত হওয়ার সম্ভবনাও অনেক বেশি থাকে। 

লক্ষন:

স্লিপ অ্যাপনিয়ার কিছু লক্ষনের কথা তো শুরুতেই বলেছিলাম। জাতীয় নাক কান গলা ইস্টিটউটের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ স্লিপ অ্যাপনিয়ার এমন কিছু লক্ষনের কথা জানিয়েছেন। যেমন:

১) অস্বাভাবিক নাক ডাকা:

অস্বাভাবিক বলতে হঠাৎ জড়ে নাক ডাকছেন আবার থেমে জাচ্ছেন। তারপর আবার ভিন্ন স্বরে নাক ডাকছেন। এর ব্যাখ্যা আপনার সাথে যিনি ঘুমান তিনি ভালো দিতে পারবেন। 

২)মাঝে মাঝে ঘুমের মধ্যে দম বন্ধ হয়ে আসা:

ঘুমের মধ্যে মাঝে মাঝেই দম বন্ধ হয়ে আসতে পারে। বিশেষ করে চিত হয়ে ঘুমালে শ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে পারে।

৩) ঘুমের মধ্যে ঝাকুনি দিয়ে যেগে উঠা বা বসে পড়া:

ঘুমের মধ্যে ঝাকুনি দিয়ে যেগে উঠা তারপর বসে পরাও স্লিপ অ্যাপনিয়ার একটি বিশেষ লক্ষন। 

৪) হৃদ স্পন্দন বন্ধ হওয়া:

স্লিপ অ্যাপনিয়ার ফলে অনেক সময় হৃদ স্পন্দনও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কিছু সময়ের জন্য হৃদ স্পন্দন বেড়ে যায়। 

৫) ক্লান্ত লাগা:

অনেক সময় ঘুমানোর পরও ক্লান্ত লাগে। যার ফলে কাজ করতে গিয়ে বা গাড়ি চালাতে গিয়ে রোগীরা হাঠাৎ করে ঘুমিয়ে পরে। ঘুম কম হওয়ার ফলে মেজাজ খীটখীটে থাকে। কারো সাথে কথা কলতে ভালো লাগে না। 

৬)ভুলে যাওয়া:

বেশিরভাগ সময় স্লিপ অ্যাপনিয়ায় আক্রান্ত রোগীরা কথা বা কাজ ভুলে যাওয়ার মত সমস্যার সম্মুখিন হয়।

স্লিপ অ্যাপনিয়া পরীক্ষা:

স্লিপ অ্যাপনিয়া আছে কিনা বুঝতে একজন বিশেষজ্ঞ একজন রোগীর কলেজ মনোগ্রাফি করে থাকে। অর্থাৎ রোগী যখন ঘুমান তখন তার চোখের মুভমেন্ট,নাক ডাকা,র্হাট,ব্রেন,ব্রেনের ওয়েস,পেশি টান,অক্সিজেন সম্পৃক্ত এমন প্রায় ২০ টি প্যারা মিটার দেখা হয়। রোগী কতক্ষন গভীর ভাবে ঘুমিয়েছেন, কখন ঘুম পাতলা হয়ে গেছে বা জেগে উঠেছে সেটি দেখা হয়। এর মাধ্যমে চিকিৎসকরা বুঝার চেষ্টা করে যে তার স্লিপ অ্যাপনিয়া আছে কিনা। থাকলে সেটা কোন পর্যায়ে আছে। এই স্লিপ স্টাডি রোগীর বাসায় বা হাসপাতালে যে কোনো যায়গায় হতে পারে। সাধারনত বাংলাদেশের বড় বড় সব ধরনের হাসপাতালে স্লিপ স্টাডির সব ধরনের সুবিধা দেওয়া হয়। 

চিকিৎসা:

প্রাথমিক পর্যায়ে স্লিপ অ্যাপনিয়া ধরা পরলে সেটা নিয়ন্ত্রনে রাখা সম্ভব। তবে দীর্ঘ দিন যদি এই সমস্যার কোন সুরাহ না করা হয় তাহলে পরিস্থিতি যটিল আকার নিতে পারে এবং শরীরে জরুরী অঙ্গ প্রতঙ্গ নষ্ট হওয়ার সম্ভবনা থাকতে পারে। এতে র্হাট অ্যাটাক, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিকস, র্স্টোক,কিডনি জটিলতা এবং ডিপ্রেশনের মত রোগও বেড়ে যাবে। যার প্রভাবে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। স্লিপ অ্যাপনিয়া জটিল আকার নিলে চিকিৎসকরা নিয়মিত রোগীকে সি প্যাক নামে একটি যন্ত্রের সাহায্য নিতে বলে। এই যন্ত্রটা একটা বাক্সের মত এবং এর সাথে পাইপের সংযোগ নিয়ে একটি মাক্স বসানো থাকে। রোগীকে প্রতিবার ঘুমের সময় এই মাক্সটি পরতে হয়। এই যন্ত্রটি মূলত রোগীর ঘুমের সময় শ্বাস নালী খোলা রাখতে সাহায্য করে এবং অক্সিজেন সরবরাহ সর্বদা নিরবিচ্ছিন্ন রাখে। ফলে শরীরের অঙ্গগুলোকে আর অক্সিজেনের ঘাটতিতে ভুগতে হয় না। এতে অনেক জটিল রোগের নিরাময় সম্ভব। তবে এই যন্ত্রটির ব্যবহার শুরুতে শুরুতে অস্যস্তিকর মনে হতে পারে। কিন্তু পরে অভ্যেস হয়ে যায়। নিয়ম হলো প্রতিবার ঘুমের সময় এই যন্ত্র ব্যবহার করা। এমনকি ভ্রমনের সময়ও সাথে রাখা। অনেকেই আছে যারা স্লিপ অ্যাপনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার পর কিছুদিন যন্ত্র ব্যবহার করার পর সেটা ফেলে রাখে কিন্তু  এমনটি করা যাবে না। জীবন যাত্রার কিছু পরিবর্তন আনলেও স্লিপ অ্যাপনিয়া নিয়ন্ত্রনে আনা যায়। যেমন ওজন নিয়ন্ত্রনে রাখা, নিয়মিত ব্যায়াম করা,সুষম খ্যাদ্যাঅভ্যাস, ডায়াবেটিস ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রনে রাখা, ধুম পান ও মদ পান পরিহার করা, সেই সাথে কাত হয়ে ঘুমানোর অভ্যেস করা। তাবে ওজন কমলেই যে স্লিপ অ্যাপনিয়া চলে যাবে এমনটি বলা যাবে না। তবে রোগ নিয়ন্ত্রনে এটি উপকারিও হতে পারে সে ক্ষেত্রে ‍নিয়ম তানন্ত্রিক ভাবে চলতে হবে। এটা ফলে জটিলতা কমবে। 

নাক ডাকার সাথে স্লিপ অ্যাপনিয়ার সম্পর্ক:

নাক ডাকা মানেই যে আপনার স্লিপ অ্যাপনিয়া আছে বিষয়টি মোটেও তেমন নয়। তবে যাদের স্লিপ অ্যাপনিয়া আছে তাদের বেশির ভাগেরি নাক ডকার মত সমস্যা দেখা যায়। সোয়ার সময় পেশি যখন সিথীল হয় তখন শ্বাসনালী সংকচিত হয়ে যায়। এত নিশ্বাস প্রশ্বাস এর সময় বাঁশির মত শব্দ হয়। আর এটাকেই নাক ডাকা বলে। যখন শ্বাসনালী বন্ধ হয়ে যায় তখন নাক ডাকাও বন্ধ হয়ে যায়। আবার ব্রেন সিগনাল দেওয়ার সাথে সাথে ঘুম ভেঙে যায় এবং রোগী আবার শ্বাস নিতে থাকে। শুধু নাক ডাকার চিকিৎসা আরো সহজ আর ভিন্ন ধরনের হয়। 

স্লিপ অ্যাপনিয়া কাদের হয়?

নারী, পুরুষ,শিশু, বৃদ্ধ বা হালকা বয়সের সবারই এই স্লিপ অ্যাপনিয়ার মত সমস্যা হতে পারে। তবে যাদের ওজন বেশি বা স্থুলতায় ভুগছেন তাদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা অনেক বেশি। যাদের গলা ও ঘার চওরা জিহবা  ভারি তাদের ও আসংকা বেশি থাকে। কেননা এদের বেশি পরিমান পেশি সিথীল হয় এবং শ্বাস নালী আটকে যায়। গলার টনসেল ফুলে গিয়েও এমনটা হতে পারে। স্লিপ অ্যাপনিয়ায় নারীদের তুলনায় পুরুষরা বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে। সাধারনত ৩৫-৫০ বছর বয়সিদের মধ্যে এই রোগে আক্রন্ত হওয়ার সম্ভবনা বেশি থাকে। বংশের কারো স্লিপ অ্যাপনিয়া থাকলে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা বেরে যায়। সাপ্রতিক এক গবেষনায় দেখা গিয়েছে যারা ধুম পান করে তাদের ক্ষেত্রে স্লিপ অ্যাপনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা তিন গুন বেশি। যারা শ্বাসকষ্ট জনিত সমস্যায় ভোগেন তাদের ও এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা বেশি। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *