ডেঙ্গু কী? ডেঙ্গুর নতুন লক্ষন গুলো কী? ডঙ্গু সারতে কত দিন সময় লাগে? মশা কামরানোর পর কী করলে পরিত্রান পাওয়া যায়? এই ধরনের নানা প্রশ্ন অনলাইন ঘুরছ সবার মাঝে। সাম্প্রতিক মাসগুলোয় ডেঙ্গু পরিস্থিতি প্রবল আকার ধারন করায় ডেঙ্গু জ্বর ও এর জিবানু বহন কারী এডিস মশার তথ্য নিয়ে মানুষের কৌতুহলের শেষ নেই। বাংলাদেশ সহ ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ অংশেও এর প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ ডেঙ্গু সংক্রমণ ঘটে। সময় এবং অঞ্চল-বিশেষে এই রোগ মহামারির আকারও ধারণ করে। বিনা চিকিৎসায়, ভুল চিকিৎসায়, এবং দেরিতে চিকিৎসার জন্য অনেক ক্ষেত্রেই রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হয়। তাই আজ এই পোস্ট এর মাধ্যমে আমি আপনাদর সাথে ডেঙ্গু নিয়ে আলোচনা করবো।
ডেঙ্গু জ্বর কী?
ডেঙ্গু একটি এডিস মশা বাহিত জনিত গ্রীষ্মকালীন রোগ। ডেঙ্গু ভাইরাস হলো ফ্ল্যাভিভাইরিডি পরিবার ও ফ্ল্যাভিভাইরাস গণের অন্তর্ভুক্ত মশা বাহিত এক সূত্রক আরএনএ ভাইরাস।এটি ডেঙ্গু জ্বরের জন্য দায়ী। ডেঙ্গু এর সামার্থক শব্দ হলো ডেঙ্গি। ডেঙ্গু বা ডঙ্গি ভাইরাসের ইংরেজি হলো Dengue virus। যাকে সংক্ষেপে DENV বলা হয়। এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমে ভাইরাস সংক্রমণের তিন থেকে পনেরো দিনের মধ্যে সাধারণত ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গগুলো দেখা দেয়। ডেঙ্গু জ্বরে অধিকাংশই ভালো হয়ে গেলেও কেউ কেউ ভীষণ দুর্বল হয়। বিষণ্ণতায় ভোগে। ডেঙ্গু মূলত দুই ধরনের:যেমন:
১) ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু ফিভার: বাকি আর পাচঁ দশটা ভাইরাস জ্বরের মত ভয় না পেলেও কোনো সমস্যা নেই।
২) ডেঙ্গু হিমোরেজিক ফিভার : জ্বরের সঙ্গে যদি প্লটিলেট কাউন্ট এক লাখের কম হয় এবং হিমাটক্রিট ২০% ভ্যারিয়েশন হয় সেটা ডেঙ্গু হিমোরেজিক ফিভার।
ডেঙ্গুর কার্যপ্রনালী:
যখন ডেঙ্গু ভাইরাস বহনকারী মশা কাউকে কামড়ায়, মশার লালার মাধ্যমে ভাইরাস ত্বকের ভিতর প্রবেশ করে। এটি বাসস্থান পাকা করে নেয় এবং শ্বেত রক্তকোষে প্রবেশ করে, এবং যখন কোষগুলি শরীরের সর্বত্র চলাচল করে তখন সেগুলির ভিতরে এই ভাইরাস প্রজননকার্য চালিয়ে যায়।ত্বকের ভিতর একবার ঢুকে যাওয়ার পর ডেঙ্গু ভাইরাস ল্যাঞ্জারহান্স কোষে এ বাসা বাঁধে। প্রবল সংক্রমণে শরীরের ভিতরে ভাইরাসের উৎপাদন অত্যধিক বৃদ্ধি পায়। তাই রক্তনালিগুলিতে কম রক্ত সংবহিত হয় এবং রক্তচাপ এত বেশি কমে যায় যে প্রয়োজনীয় অঙ্গসমূহে যথেষ্ট পরিমাণে রক্ত সরবরাহ হতে পারে না। এর ফলে অনেক সময় কিডনি বা অস্তিমজ্জার ক্ষতি হতে পারে। অস্থিমজ্জা কাজ না করায় অনুচক্রিকা বা প্লেটলেটসের সংখ্যা কমে যায় যা কার্যকরী রক্ততঞ্চনের জন্য দরকারি। এতে রক্তপাতের সম্ভাবনা বেড়ে যায় যা ডেঙ্গু জ্বরের অন্যতম বড় সমস্যা। আর এটা এখনও পুরোপুরি পরিষ্কার নয় যে কেন ডেঙ্গু ভাইরাসের এক ভিন্ন পর্যায়যুক্ত মাধ্যম সংক্রমণে মানুষ ডেঙ্গু হেমারেজিক ফিভার ও ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে আক্রান্ত হয়।
ডেঙ্গুর লক্ষন:
প্রথমবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর বিশেষ কোন উপসর্গ বা লক্ষণ দেখা যায় না। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে কিছু লক্ষন দেখা দিত পারে। ডেঙ্গু জ্বরের সাধারন লক্ষন বা উপসর্গ গুলো হলো:
১) উচ্চ জ্বর। রোগীর প্রচুর জ্বর হতে পারে (১০২°F-১০৫°F)।
২) তীব্র মাথার ব্যাথা ও চোখের পিছনে ব্যথা।
৩) বমিভাব ও মাথাঘোরা।
৪) ত্বকের বিভিন্ন স্থানে ফুসকুড়ি হওয়া।
৫) প্রচণ্ড পেট ব্যথা।
৬) মারি বা নাক থেকে রক্তপাত হওয়া।
৭) বমি ভাব বা বমি হওয়া।
৮) প্রস্রাবে এবং মলের সাথে রক্তপাত হওয়া।
৯) দ্রুত শ্বাস প্রশ্বাস যাওয়া ও ক্লান্তি লাগা।
১০)মাংসপেশি এবং অস্থি সন্ধি তে যন্ত্রণা হওয়া।
ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসা:
উপরের উপসর্গ গুলো দেখলে দ্রুত একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘরোয়া চিকিৎসাতেই কমে যায়। জ্বর হলে চিকিৎসকরা এনএস ১ অ্যান্টিজেন,ভাইরাস আইসোলেসন, অ্যান্টিবডি পরীক্ষা, প্লাটিলেট কাউন্ট ও হিমাটক্রিট এই ধরনের পরীক্ষা নীরিক্ষা করার পরামর্শ দিয়ে থাকে। ডেঙ্গুর চিকিৎসার বিশেষ কোন ওষুধ বা প্রতিষেধক এখনো পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। চিকিৎসকরা প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ দিয়ে যন্ত্রণা এবং জ্বরের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করেন। প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য ওষুধ ব্যবহার করা উচিত না। অ্যন্টিবায়টিক জাতীয় ওষুধ দ্রুত জ্বর নামিয়ে, ঘাম ঝরিয়ে নিতে পারে, কিডনির ক্ষতি করতে পারে এবং খাদ্যনালিতে রক্তক্ষরণ ত্বরান্বিত করে জীবনের ঝুঁকি ডেকে আনতে পারে। তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা প্রতি ৬ ঘন্টা পর পর রোগীকে প্যারাসিটামল নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। আর প্রচুর পরিমানে পানি পান করার পরামর্শ দিয়ে থাকে চিকিৎসকরা। মূলত প্যারাসিটামল ও পানিই ডেঙ্গুর আসল চিকিৎসা। তাই প্রতিদিন কমপক্ষে কয়েকদিন তিন লিটার পানি পান করতে হবে। প্রয়োজনে স্যালাইন নিতে পারলে ভালো।
ডেঙ্গু রোগে করা উচিত:
১) ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে প্রচুর পরিমানে বিশ্রাম নিতে হবে।
২)পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি এবং তরল জাতীয় খাবার খেতে হবে। শরীরে জলীয় অংশ বেশি থাকলে মাথাব্যথা ও পেশি ব্যথা কম হবে।
৩) পেয়ারার শরবত পান করা যেতে পারে। ভিটামিন সি সমৃদ্ধ এই পানীয়টি রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সকৃয় করে ডেঙ্গু সংক্রমণ উপশম করবে।
৪) ডেঙ্গু রোগীর প্লাটিলেট কমে যায়। তাই প্লাটিলেট বাড়ে এমন খাবার খেতে হবে। রক্তের প্লাটিলেট বাড়াতে নিম পাতার রস ভালো কাজ করে। এটি শ্বেত রক্তকনিকার সংখ্যাও বৃদ্ধি করে। নিম পাতার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর গুণও আছে।
৫) সাইট্রাস ফল, কাঠবাদাম, দই, সূর্যমুখী বীজ, গ্রিন টি, ক্যাপসিকাম, ব্রোকলি, পালংশাক, আদা, রসুন ও হলুদ এ জাতীয় খাবার শরীরের জন্য খুবই উপকারী।
ডেঙ্গু রোগে করা অনুচিত:
১) ডেঙ্গু জ্বরের ক্ষেত্রে প্লাটিলেট এখন আর মূল বিষয় নয়। প্লাটিলেট হিসাব নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।
২) অনেকে বলেন, পেঁপেপাতার জুস ইত্যাদি খেলে প্লাটিলেট বাড়ে। আসলে এসবের কোনো ভূমিকা নেই। জ্বর কমে যাওয়ার পর কিছু দিন পেরিয়ে গেলে আপনা আপনি থেকেই প্লাটিলেট বাড়তে শুরু করে। প্লাটিলেট কাউন্ট ১০ হাজারের নিচে নামলে বা শরীরের কোনো জায়গা থেকে রক্তপাত হলে প্রয়োজন বোধে প্লাটিলেট বা ফ্রেশ রক্ত দেওয়া যেতে পারে। এ ধরনের পরিস্থিতি খুবই কম দেখা যায়। তাই এ নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কোন কারন নেই।
৩)ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে গায়ে ব্যথার জন্য অ্যাসপিরিন, ক্লোফেনাক, আইবুপ্রোফেন জাতীয় ওষুধ খাওয়া যাবে না। ডেঙ্গুর সময় এ জাতীয় ওষুধ গ্রহণ করলে রক্তক্ষরণ হতে পারে।
৪) কোনো ব্যক্তির যদি লিভার, হার্ট এবং কিডনি সংক্রান্ত জটিল রোগ থাকে, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অতিরিক্ত প্যারাসিটামল সেবন করা যাবে না।
৫) গুরুতর পর্যায় হলে প্রয়োজনে শিরাপথে স্যালাইন দেওয়া লাগতে পারে। এসব ক্ষেত্রে তাই হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।
ডেঙ্গুর প্রতিকার বা প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা:
১) আপনার চারপাশের জায়গা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখুন।
২) পানি হল এডিস মশার বংশ বিস্তারের স্থান, তাই মশা বংশ বিস্তার বন্ধ করতে পারলে এ রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনাও কমে যায়। প্রয়োজনে জমে থাকা পানিতে ব্লিচিং পাউডার ছিটান।
৩) ফুলের টব, এসি ,ফ্রিজর নিচ সহ বাসার যে কোন স্থানের আবদ্ধ পানি নিয়মিত ভাবে ফেলে দিন।
৪) পানি জমে থাকতে পারে এমন জিনিস উল্টে রাখুন। এছাড়া পরিত্যক্ত টায়ার, ডাবের খোসা, প্লাস্টিকের বোতল এবং আশে পাশে পরে থাকা পাত্রের জমা পানি প্রতি তিন দিনের মধ্যে ফেলে দিন।
৫)পাতলা বা ঢোলা পোশাক পরা থেকে বিরত থাকুন।
৬) দিনে বা রাতে ঘুমানোর আগে অবশ্যই মশারি ব্যবহার করুন।
৭) জানালাতে মশা প্রতিরোধক নেট ব্যবহার করুন।
৮) মশা নিধনের ওষুধ কিংবা স্প্রে ব্যবহার করুন।
৯) শরীরের অনাবৃত স্থানে মশা নিধরক ক্রিম ব্যবহার করুন।
১০) শিশু ও বয়ষ্কদের বিশেষ যত্ন নিন।